টুলো পণ্ডিত

পশ্চিমমুখো কয়েক পা হাঁটলেই গঙ্গা। রাজা রাজবল্লভ ষ্ট্রিট থেকে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজও খুব বেশি দূর নয়। অর্ধ বাংলার রাজধানী নাটোর থেকে এসে রাজা রাজবল্লভ ষ্ট্রিটেই বাসা বেঁধেছিলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার। প্রাচীন শাস্ত্রানুরাগী রক্ষণশীল পরিবারের সন্তান। টোল ছিল বাগবাজারের বাসাতেও। ছাত্র ১৫ জন। ইউরোপীয় সভ্যতার প্রভাব সম্বন্ধেও তিনি পুরোপুরি সচেতন। টোলে পড়াতেন ন্যায় ও স্মৃতির সঙ্গে উপনিষদ, বেদান্তও। আর, ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে ইউরোপীয় ছাত্রদের বাংলা। পরে সংস্কৃতও। নিজের ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি এই টুলো পণ্ডিত ইউরোপীয় শিক্ষকদের পাশে বসে তাঁদের ক্লাস নেওয়াতেও সাহায্য করতেন।
রুক্ষমূর্তি, স্থূলকলেবর এই পণ্ডিতের যেন দু’টো সত্তা ছিল। একটা বাগবাজারের। আর একটা ফোর্ট উইলিয়মের। এক দিকে, শাস্ত্রে অনায়াস অধিকার। ভাষা কখনও জটিল সমাসবদ্ধ, ভারী, দুরূহ। কখনও খুবই আধুনিক। সাবলীল, অনাড়ষ্ট। বেদান্তদর্শন নিয়ে আলোচনা করছেন, আবার কথনও গ্রাম্য রসিকতাও করছেন নির্বিকার ভাবে। রক্ষণশীলদের মুখপাত্রের ভূমিকা নিয়ে রামমোহনের বিরোধিতায় সরব। তার পরেই তাঁকে দেখা যাচ্ছে, রক্ষণশীলদের দাপটকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে সহগমনের বিরোধিতা করছেন শাস্ত্রবচন শুনিয়েই।
এই স্ববিরোধিতার মধ্যে ঠিক মানুষটিকে চিনে নেওয়া সত্যিই শক্ত। তার উপরে, এখন তাঁর সঙ্গে আমাদের দূরত্ব দু’শো বছরের। তাঁর ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে কিছুই প্রায় জানা যায় না। অতএব ভরসা বলতে কেবল মৃত্যুঞ্জয়ের রচনাবলিই।
আর, সেখানেও স্ববিরোধ কম নয়। বাংলা ভাষার এখনকার চেহারাটার প্রথম কাঠামো তাঁর হাতেই তৈরি। অথচ, সত্যি বলতে কী, প্রাক্‌ রামমোহন পর্বের শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী বলে স্বীকৃত মৃত্যুঞ্জয়ের রচনাবলি তাঁর সমসময়ে বাঙালিরা পড়তে পারেননি। সেগুলো লেখাই হয়েছিল ইউরোপীয়দের জন্য। তাঁরাই পড়তেন। এবং বেশ আমোদ করেই পড়তেন।
এবং পড়বেন নাই বা কেন? মৃত্যুঞ্জয়কে বলা হয়েছিল, এমন করে এ দেশের রীতিনীতি, আদবকায়দা এবং ইতিহাস লিখতে হবে, যাতে তা পড়ার মধ্যে কোনও ক্লান্তি না আসে। বরং পড়তে ভাল লাগে। তরুণ সাহেবরা এ দেশে আসত প্রথমত আমোদ করতে, দেশ শাসনের ঝক্কি তার পরে। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে পড়ার সময়ে যে অর্থ তারা স্টাইপেণ্ড হিসেবে পেত, তা সে কালের তুলনায় যথেষ্টরও বেশি। মাসে তিনশো টাকা। থাকার বন্দোবস্ত ছিল কলেজেই। ছাত্রদের এমনকী, নিখরচায় কাজের লোকও জোগাত কলেজ। কিন্তু তাতেও তাদের কুলোতো না। চাকরি পেয়ে শোধ করার চুক্তিতে বহু টাকা ধার করত তারা। রীতিমতো ভাল মাইনের চাকরি পাওয়ার পরেও সে টাকা কিন্তু শোধ করতে পারত না। খরচ বরং উত্তরোত্তর বেড়েই চলত। বহু ধুরন্ধর বাঙালি এই সাহেবদের উদার হাতে টাকা ধার দিয়ে রাতারাতি বড়লোক হয়ে গিয়েছিলেন। এই বিশাল অর্থের অনেকটাই যেত দেশ থেকে দূরত্বের দুঃখ ভুলে থাকার নানা উৎকট আমোদে। যদি কোনও ইউরোপীয় অনূঢ়া সুন্দরী মেলে তো কথাই নেই। তার জন্য ডুয়েল শুরু হত মানি পাওয়ারের। শেষ হত মাসল পাওয়ারে। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গেই চলত এদেশি নারী ভোগের জন্য অকাতর অর্থ ব্যয়।
অথচ, মাত্র কয়েক বছর আগেই, ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে, কোম্পানির সামরিক বিভাগের শিক্ষানবিশ হয়ে কলকাতা এসেছিলেন জন শোর টেনমাউথ। তিনি মাইনে পেতেন মাসে ৮ টাকা। ১৭৮০ সালে স্যার টমাস মুনরো পেতেন আর একটু বেশি। মাসে পাঁচ প্যাগোডা বা ৩৫ শিলিং।
পড়াশোনায় এঁদের মনোযোগী করতে হলে সোজা কথাটা যে সোজা কথাতেই বললে চলবে না, তা জানতেন বড়লাট থেকে উইলিয়ম কেরি পর্যন্ত সকলেই। তাঁরা চেয়েছিলেন কাহিনীর আশ্রয় নিয়ে এই সম্পূর্ণ অপরিচিত দেশটার মানুষ সম্বন্ধে জ্ঞাতব্য তথ্যগুলো তরুণ সিভিলিয়ানদের বুঝিয়ে দিতে।
আর, মৃত্যুঞ্জয়ের মুক্তি ঠিক এখানেই। তিনি আখ্যানের খোলা পথ পেয়ে কল্পনার রাশ টানেননি। তাঁর বেশির ভাগ রচনাই অনুবাদ। কিন্তু সংস্কৃতে সুপণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় যে সব সময়ে মূলের আক্ষরিক বঙ্গীকরণ করেছেন, তা মোটেই নয়। তিনি বরং গল্পগুলো নিজের মতো করে বলতে চেয়েছেন। পাণ্ডিত্য দেখানোর কোনও দরকার তাঁর ছিল না। বরং এই সুযোগটা কাজে লাগিয়েছেন সবে পাক ধরা একটা ভাষার বৈচিত্র্য ও শৈলী নিয়ে অনুশীলন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। সেই সঙ্গে, তাঁর যা নিজের মতো করে বলা, বলতে বাধ্য হচ্ছি, দু’শো বছর পরেও বাঙালির পাকযন্ত্রে হজম হওয়া শক্ত।
১৮০২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বই। ‘বত্রিশ সিংহাসন’। আখ্যানের মূল সুরটা বেঁধে দিতে গিয়ে মৃত্যুঞ্জয় লিখছেন, ‘‘বড়লোক সেই যাহার গুণ অন্যে বর্ণন করে আপন গুণ আপনি বর্ণন করনেতে কিছু ফল নাহি পরন্তু লোকেরা নির্লজ্জ বলে যেমত যুবতি স্ত্রী আপনি ...আপনি মর্দ্দন করিলে কিছু সুখ নাহি কিন্তু লোকেরা নির্লজ্জ বলে। পুত্তলিকার এই বাক্য শুনিয়া রাজা অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া কহিলেন হে পুত্তলিকে এ সিংহাসন কাহার ও কী রূপে হইয়াছে বৃত্তান্ত কহ। পুত্তলিকা কহিলেন মহারাজ সিংহাসনের বৃত্তান্ত শুন—’’ একশো খণ্ড ‘বত্রিশ সিংহাসন’ ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ কিনেছিল। মৃত্যুঞ্জয় পারিতোষিক পেয়েছিলেন ছয়শো টাকা।
শ্লীল-অশ্লীলের সীমাটা তিনি টেনেছিলেন সে কালের বাগবাজার আর ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের রীতি অনুযায়ীই। এমন অনেক শব্দ এবং উপমা তিনি নিশ্চিন্তে ব্যবহার করেছেন, যা এখন লিখতে হাত কাঁপবে। এর উপরে মনে রাখা দরকার, তিনি কিন্তু আসলে পাঠ্যপুস্তক প্রণেতা। সেই সঙ্গে চূড়ান্ত পেশাদারও। মৃত্যুঞ্জয় সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরীর মন্তব্যটি তাই প্রণিধানযোগ্য—‘‘তিনি একদিকে যেমন সাধু-ভাষার আদি লেখক, অপরদিকে তেমনি চলতি ভাষারও আদর্শ লেখক।’’
ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ প্রতিষ্ঠাই হয়েছিল তরুণ ব্রিটিশ সিভিলিয়ানদের এ দেশের হাল হকিকত জানানোর জন্য। তার জন্য দরকার ছিল বাংলা ও সংস্কৃত ভাষাটা ঠিক মতো জানা। কারণ, ব্রিটিশ ভারতের সেই সময়ের মানচিত্রের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলটাই ছিল এই ভাষার অধিকারে। বাংলার গুরুত্বটা প্রথম বুঝেছিলেন ন্যাথানিয়াল ব্রাশি হ্যালহেড নামে এক স্বদেশকাতর, রোম্যান্টিক সাহেব। তাঁর বাংলা ব্যাকরণ লেখায় হাত দেওয়ার কারণটাই ছিল, প্রশাসনে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির তৎপরতা বাড়াতে এ দেশের ভাষার সঙ্গে কর্তৃপক্ষ এবং ইউরোপীয় কর্মচারীদের সড়গড় করে তোলা।
বাংলা চর্চার দরকারটা হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলেন লর্ড ওয়েলেসলিও। কলেজ স্থাপনের পরে বাংলা চর্চায় নিবেদিত কেরিকেই দায়িত্ব দেওয়া হল বাংলা বিভাগের শিক্ষক ঠিক করার। কেরি প্রথমেই তাঁর বাংলা শিক্ষক এবং মুন্‌শি রামরাম বসুকে নিয়ে নিলেন। বেতন মাসে ৪০ টাকা। রামরামের গদ্যের হাত চমৎকার। কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞানও রীতিমতো ভাল। মিশনারিদের সঙ্গে সখ্য যথেষ্ট। ভূষণার রাজপুত্র দোম আন্তনিওর পথেই রামরাম পা ফেলবেন বলে ব্যাপটিস্ট মিশনারি টমাস থেকে কেরি পর্যন্ত সকলেই আশায় আশায় ছিলেন। আরকানের হাটে বিক্রি করে দেওয়ার জন্য মগ বোম্বেটেরা ভূষণার রাজপুত্রকে অপহরণ করে। তখন তাঁকে রক্ষা করেছিল পর্তুগিজ পাদ্রিরা। তিনি খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, এবং পরে বাংলায় ‘ব্রাহ্মণ-রোমান ক্যাথলিক সংবাদ’ লিখেছিলেন। কিন্তু রামরাম শেষ পর্যন্ত সে দিকে হাঁটেননি। তবে তার চেয়েও বড় কথা, তিনি এর আগেই পদ্যে বাংলা লিখেছেন। রামরামের জন্ম আনুমানিক ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে, চুঁচুড়ায়। কুড়ি বছর বয়সে তিনি ব্যাপটিস্ট মিশনারি টমাসের সংস্পর্শে আসেন। বুদ্ধিমান রামরামের মিশনারিদের পাশাপাশি বেশ কয়েক জন উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারীর সঙ্গেও সুসম্পর্ক ছিল। আর ১৭৯৩ সালে কেরি এ দেশে আসার পর থেকে টমাসের পরামর্শে রামরামই তাঁর মুন্‌শি। বেতন মাসে ২০ টাকা। অর্থাভাবে কেরি মালদহের মদনাবাটীতে জর্জ উডনির নীলকুঠিতে চাকরি নিলে রামরামও সেখানে যান।
মদনাবাটীতে ঠিক কী হয়েছিল, যার জন্য কেরি রামরামকে তাড়িয়ে দেন তা কিন্তু অস্পষ্ট। মোটামুটি ভাবে মনে করা হয়, সেখানকার এক বিধবা মহিলার সঙ্গে রামরামের প্রণয়ের জেরে ব্যাপক গোলমাল শুরু হয়। পরে তাঁদের পুত্র হলে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে যায়। অপবাদের হাত থেকে বাঁচতে রামরাম সেই পুত্রকে হত্যাও করেন। সেটা জানাজানিও হয়ে যায়। সম্ভবত এর পরেই কেরি তাঁকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু রামরামের প্রতি তাঁর আস্থা অবিচল ছিল। ১৮০০ সালে শ্রীরামপুরে ব্যাপটিস্ট মিশন স্থাপিত হলে রামরাম সেখানে গিয়ে কেরির সঙ্গে দেখা করেন। কেরি রামরামকে অল্প বেতনে মিশনের কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। রামরাম সেখানে ১০০ পংক্তির হরকরা (‘গসপেল মেসেঞ্জার’) অনুবাদ করেন। অর্থাৎ অনুবাদের হাতটা ছিল। এমনকী, তাঁর আরবি-ফারসি বহুল ভাষার প্রভাব পড়েছিল কেরির লেখাতেও। ১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’। পরের বছরেই ‘লিপিমালা’।
কিন্তু রামরামের সংস্কৃত ভিত সে রকম গভীর নয়। দরকার ছিল একজন প্রকৃত সংস্কৃতজ্ঞের। কেরির সঙ্গে মৃত্যুঞ্জয়ের হয়তো আগে থেকেই আলাপ ছিল। পণ্ডিত হিসাবে মৃত্যুঞ্জয়ের খ্যাতিও সম্ভবত তখনই বেশ ভাল রকম ছড়িয়ে পড়েছিল। নতুন কলেজে বাংলার বিভাগে কেরির ঠিক পরের আসনটাই পেলেন মৃতুঞ্জয়। কেরি, মার্শম্যান-সহ অনেকেই মৃত্যুঞ্জয়ের কাছেই সংস্কৃত শিখেছিলেন। মার্শম্যান মৃত্যুঞ্জয়কে ডক্টর জনসনের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।
পাণ্ডিত্যের সঙ্গে রসিকতাতেও মৃত্যুঞ্জয়ের সমান অধিকার। তাঁর চরিত্রের একটি ধ্রুব দিক অনাবিল রসিকতাবোধ। যা লিখছেন, যখন লিখছেন, ভিতরে ভিতরে বয়ে চলেছে রসিকতার একটা স্রোত। না হেসে থাকতে পারছেন না। দু’শো বছরের দূরত্বে তাঁর রসিকতা গ্রাম্য ঠেকবে। এমনকী, অশ্লীলও। কিন্তু ‘প্রবোধ চন্দ্রিকা’-র ভূমিকাতে জোশুয়া ক্লার্ক মার্শম্যান লিখছেন, ‘‘শৈলীর বৈচিত্র দেখাতে গিয়ে কোথাও কোথাও নীচু শ্রেণীর ভাষাও ব্যবহার করেছেন। কিন্তু সেই অশ্লীলতা তাঁর মৌলিক রসিকতার স্রোতে পুরোপুরি মিটে গিয়েছে।’’
এ বার বইটির তৃতীয় স্তবকের প্রথম কুসুমে আসা যাক। কোচবিহারের শত্রুমর্দন নামে নিঃসন্তান এক রাজার কথা এখানে লিখছেন মৃত্যুঞ্জয়। রাজা অনেক শান্তি-স্বস্ত্যয়ন করলেন। তার পর এক দিন ‘‘রানীর উদর স্ফীত উত্তরোত্তর অতিশয় হইল।’’ সবাই ভাবলেন রানী সন্তানবতী হতে চলেছেন। এক দিন রানীর পেটে যন্ত্রণা শুরু হল। দাসীরা এসে রাজাকে বলল রানীর প্রসব সময় অাগত। এর পর মৃত্যুঞ্জয় লিখছেন, ‘‘অতি বড় সমারোহ করিয়া রাজা বসিয়া আছেন ইত্যবসরে অন্তঃপুরে ধাত্রীবর্গেরা রানীকে শূল দিতে লাগিল তাহাতে তাহার উদর হইতে বিজাতীয় শব্দ করিয়া এক অধোবায়ুমাত্র নির্গত হইল। সে শব্দ শুনামাত্রে স্ত্রীলোকেরা কি হইল ২ ইহা কহিয়া সূতিকাগৃহে গিয়া দেখিল রানীর উদর স্বভাবস্থ হইয়াছে রানী রোগমুক্তা প্রায় সুস্থ হইয়া বসিয়াছেন। এইরূপ দেখিয়া স্ত্রীবর্গেরা কহিল ও মা একি লাজের কথা দশ মাসের গর্ভ কি এক বাৎকর্মেই গেল।’’
কী আশ্চর্য স্ববিরোধ। লৌকিক ভাষার প্রতি এই লোকেরই কিন্তু যথেষ্ট বীতরাগ। এবং তা প্রকাশ করেছেন কী ভাষায়—‘‘যেমন রূপালঙ্কারবতী সাধ্বী স্ত্রীর হৃদয়ার্থবোদ্ধা সুচতুর পুরুষেরা দিগম্বরী অসতী নারীর সন্দর্শনে পরাঙ্মুখ হন, তেমনি সালাঙ্কারা শাস্ত্রার্থবতী সাধুভাষার হৃদয়ার্থবোদ্ধা সৎপুরুষেরা নগ্না উচ্ছৃঙ্খলা লৌকিক ভাষা শ্রবণ মাত্রেতেই পরাঙ্মুখ হন।’’
মৃত্যুঞ্জয়ের জন্ম ১৭৬২ বা ১৭৬৩ সালে। মৃত্যুঞ্জয়ের পৌত্র বিহারীলাল চট্টোপাধ্যায় ১৮৮৯ সালে ‘রাজাবলি’-র পঞ্চম সংস্করণ প্রকাশ করেন। তাঁর কাছ থেকেই পাওয়া তথ্যের উপর নির্ভর করে অক্ষয়চন্দ্র সরকার মৃত্যুঞ্জয়ের জন্মের সাল ১৭৬২ বলে মনে করেন। সালটা ভুল কি ঠিক, তা নিয়ে অবশ্য নিঃশংসয় হওয়া যায় না।
জন্ম মেদিনীপুরে। একটা সময়ে পণ্ডিতরা মনে করতেন, মৃত্যুঞ্জয় সম্ভবত ওড়িশার মানুষ। এমনকী, ওড়িয়া ভাষায় অনূদিত বাইবেলও তাঁর রচনা বলে মনে করা হত। এখন অবশ্য জানা গিয়েছে, ওই বাইবেলের লেখক পুরুষরাম নামে ওড়িশার এক সুখ্যাত পণ্ডিত। ‘রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ, খনের চাটুতি শ্রীকরের সন্তান’ মৃত্যুঞ্জয় বাঙালিই ছিলেন। তাঁর পিতার নাম ছিল শ্রীকর। পদবি চট্টোপাধ্যায়। আবার, তাঁকে ‘মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার ভট্টাচার্য’ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। সমাচার দর্পণে প্রকাশিত তাঁর মৃত্যুসংবাদে জানা যায়, সুপ্রিম কোর্ট থেকে ছুটি নিয়ে তীর্থ করে ফেরার পথে ১৮১৯ সালের জুন নাগাদ মুর্শিদাবাদের কাছে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর এক পুত্রের খবর পাওয়া যায়। রামজয় তর্কালংকার। তিনিও পিতার মতো ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে পড়িয়েছেন। তাঁরও পণ্ডিত হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতি ছিল।
মৃত্যুঞ্জয়ের ছোটবেলা মেদিনীপুরে কাটলেও পরে তিনি নাটোরে চলে যান। নাটোরের সভাপণ্ডিতের কাছেই তাঁর প্রকৃত শিক্ষালাভ। যৌবনে চলে আসেন কলকাতায়। রাজবল্লভ ষ্ট্রিটে তাঁর চতুষ্পাঠীতে মূল উপনিষদ ও তার শাংকর ভাষ্য, বেদান্ত পড়াতেন। স্মৃতিশাস্ত্রেও মৃত্যুঞ্জয়ের অধিকার ছিল। পণ্ডিত হিসেবে নাম ছড়িয়ে পড়ার পরে কেরির সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। সদ্যপ্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে বাংলার প্রধান পণ্ডিতের পদে কেরি নিয়ে নেন মৃত্যুঞ্জয়কে। বেতন মাসে ২০০ টাকা, সে কালের হিসেবে যা রীতিমতো ঈর্ষাজনক। কোনও এ দেশি পণ্ডিতই এর চেয়ে বেশি মাইনে পেতেন না সে সময়। ইউরোপীয়রা অবশ্য অনেক বেশি পেতেন। সব চেয়ে বেশি পেতেন জন বেলি। তাঁর বেতন ছিল মাসে ১ হাজার ৬০০ টাকা। এর উপরে আরবি ভাষার অনুবাদের জন্য তিনি পেতেন আরও হাজার টাকা। হিন্দুস্থানির অধ্যাপক জন বর্থউইক গিলক্রাইস্টও সে সময় এক হাজার টাকা বেতন পেতেন।
কেরি এমন এমন লোককেই কলেজে নিয়ে এসেছিলেন, যাঁরা শুধুই পণ্ডিত নন, সেই সঙ্গে, এটাও বোঝেন, কী করে এ দেশের ভাষা-সমাজকে চিনিয়ে দিতে হয়। কেরি জানতেন কোনও পাঠ্যসূচি সামনে নেই। নেই পাঠ্যপুস্তকও। এমন করে লিখতে হবে যাতে উচ্ছৃঙ্খল ইউরোপীয় যুবকেরাও পড়াশোনায় মন দেয়।
মৃত্যুঞ্জয় তাঁর প্রথম বইয়েই বুঝিয়ে দিলেন, কাজটা তিনি ভাল করেই করবেন। ‘অভিনব যুবক সাহেবজাতের শিক্ষার্থ’ একের পর এক বই লিখলেন। ১৮০৮ সালে ‘পঞ্চতন্ত্র প্রভৃতি নীতিশাস্ত্র থেকে উদ্ধৃত...বিষ্ণুশর্ম্ম কর্তৃক সংগৃহীত’ ‘হিতোপদেশ’ অনুবাদ, সে বছরেই প্রকাশ পায় ভারতের ইতিহাস ‘রাজাবলি’। ১৮১৬-র আগেই লিখেছিলেন ‘হিন্দু সাহিত্য’ সংক্রান্ত নিবন্ধাবলি ‘প্রবোধচন্দ্রিকা’। শুধু ছাপা বইয়ের হিসেবেই মৃত্যুঞ্জয় সে যুগে অদ্বিতীয়।
লক্ষ্য ছিল দেশীয় ন্যায় ও বিচারের পদ্ধতি সম্বন্ধে সাহেবদের ওয়াকিবহাল করে তোলা। নানা রকম গল্পের মাধ্যমে মৃত্যুঞ্জয় সে সব বলেছেন। এবং বলেছেন রীতিমতো আকর্ষক ভঙ্গিতে। যেমন কাশ্মীররাজের প্রতি কেকয়রাজের শত্রুতা। ‘অজাতপুরুষসংসর্গা’ বলে ‘নিপুণা এক বেশ্যাকে’ কেকয়রাজ পাঠিয়ে দিলেন কাশ্মীররাজের কাছে। কাশ্মীররাজও যথেষ্ট বুদ্ধি ধরেন। কেকয়রাজের পাঠানো মহিলাকে তিনি আগে পরীক্ষা করতে চান। কিন্তু কয়েক দফা পরীক্ষার পরেও রাজার সন্দেহ কাটল না। তিনি এ বার এক চতুর অন্ধকে পাঠালেন। তিনি গিয়ে মহিলাকে বললেন, অন্ধ বলে শরীর স্পর্শ করে পরীক্ষা করবেন। মহিলাও তাতে রাজি। ‘‘অনন্তর ঐ অন্ধ কেশ মস্তক কপাল গণ্ড চক্ষু নাসিকা কর্ণ ওষ্ঠাধর কণ্ঠ গ্রীবা পৃষ্ঠ পার্শ্ব বাহুমূল ভুজ পাণি অঙ্গুলি কক্ষ বক্ষ কুচ চুচুক কুক্ষি নাভি বস্তি কটি বংক্ষণ ঊরু জানু জঙ্ঘা পাদ পদতল পর্য্যন্ত শনৈঃ শনৈঃ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সকলে হস্ত প্রদানে ঐ স্ত্রীর পরপুরুষসংস্পর্শে কিছুমাত্র অঙ্গ সংকোচ না হওয়াতে তাহার মর্ম্ম বুঝিয়া রাজসমক্ষে আসিয়া সবিশেষ বিজ্ঞাপন করিয়া কহিল হে মহারাজ এ স্ত্রী বেশ্যা।’’
সেই সঙ্গেই তাঁর অনবদ্য রসিকতাবোধ। গৌড়দেশের কৌশাম্বী নগরীর চন্দন দাস নামে এক ধনী বৃদ্ধ ও তাঁর স্ত্রী লীলাবতীর আখ্যানে একেবারে নিজস্ব বাচনভঙ্গিতে লিখছেন, ‘‘এক দিবস রত্নসমূহ খচিত পর্য্যঙ্কে সেই বণিক্‌পুত্রের সহিত প্রিয়ালাপেতে সুখোপবিষ্ট সেই লীলাবতী অকস্মাৎ উপস্থিত ঐ পতিকে দেখিয়া হঠাৎ উঠিয়া কেশেতে আকর্ষণ করিয়া নির্ভর আলিঙ্গন করিয়া চুম্বন করিল সেই অবসরে উপপতি পলাইল।...অতএব আমি বলি যুবতি স্ত্রী বৃদ্ধ পতিকে অকস্মাৎ নির্ভর আলিঙ্গন করিয়া কেশে ধরিয়া চুম্বন করিল ইহাতে কোনহ কারণ থাকিবেক।’’
১৮০৫ সালে কলেজে সংস্কৃত পড়ানোর জন্য কেরি মৃত্যুঞ্জয় ও রামনাথ বাচস্পতির নাম প্রস্তাব করেন। প্রস্তাবে কেরি লিখেছিলেন, ‘‘যে সব সংস্কৃত পণ্ডিতদের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে ইনি তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।’’ কেরির সঙ্গে পরিচিত সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতের সংখ্যা বড় কম ছিল না। এ বিষয়ে তাঁর মতামতের দাম আছে। কিন্তু পনেরো বছর ধরে সুনামের সঙ্গে অধ্যাপনার পরেও মৃত্যুঞ্জয়ের বেতন বাড়েনি। শ্বেতাঙ্গ সমাজে অবশ্য খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৮১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার ম্যাকনটন তাঁকে জজ পণ্ডিতের পদ গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন। জজ পণ্ডিতের কাজ ছিল আদালতে যে সব মামলায় হিন্দু আইনের পরামর্শ লাগত সেগুলি জোগানো এবং অত্যন্ত জটিল সেই সব আইনের ব্যাখ্যা দেওয়া। মৃত্যুঞ্জয় দু’বছর জজ পণ্ডিতের কাজ করেন। এই সময়ে তাঁর অভিজ্ঞতার সার হল—‘‘ধনাঢ্য যত লোক সুপ্রিম কোর্টে প্রবিষ্ট হইয়াছেন তাঁহারা একেবারে নিঃস্ব হইয়া সেই আদালত হইতে মুক্ত হইয়াছেন।’’
কিন্তু এই সময়ে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ তিনি করেছিলেন যার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। ১৮১৭ সালে সদর দেওয়ানি আদালতের প্রধান বিচারপতি সহগমন সম্পর্কে হিন্দু শাস্ত্রীয় বিধান জানতে চান তাঁর কাছে। মৃত্যুঞ্জয় সংস্কৃতে তার যে উত্তর দিয়েছিলেন ১৮১৯ সালে ‘ফ্রেণ্ড অব ইণ্ডিয়া’ তাঁর বক্তব্যের সারাংশ ইংরেজিতে ছাপিয়ে দিয়েছিল। সেখানে তিনি লিখছেন, ‘‘চিতারোহণ অপরিহার্য নয়,— ইচ্ছাধীন বিষয়মাত্র। অনুগমন এবং ধর্মজীবনযাপন— এই উভয়ের মধ্যে শেষটিই শ্রেয়তর। যে স্ত্রী অনুমৃতা না হয় অথবা অনুগমনের সঙ্কল্প হইতে বিচ্যুত হয়, তাহার কোন দোষ বর্তে না।’’ (অনুবাদ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়)। তাঁর বক্তব্য ছিল, যদি কোনও পুত্র পিতা মারা গেলে মাকে সহগমনে বাধ্য করে, তা হলে তার নারীহত্যা ও মাতৃহত্যা এই দুই পাপই বর্তাবে।
সহমরণের বিরুদ্ধে খোদ রামমোহনেরও যুক্তি ছিল একই। ১৮১৮ সালে সহমরণ নিয়ে তাঁর প্রথম পুস্তিকাতে রামমোহনও বলেছিলেন, সহগমন ও ব্রহ্মচর্যের মধ্যে দ্বিতীয়টিই শ্রেয়। অর্থাৎ, রামমোহনের আগেই তিনি সতীদাহ বিরোধিতা করে একেবারে শাস্ত্রীয় যুক্তি উপস্থিত করেছিলেন। অথচ, রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ তখন রামমোহনের বিরুদ্ধে। বাগবাজারের এই টুলো পণ্ডিত কিন্তু তাতে এতটুকু দমেননি। যা ঠিক মনে করেছেন, তা-ই করেছেন। এবং, সেই সঙ্গে মনে রাখা দরকার, রামমোহনের সঙ্গে তাঁর মোটেই প্রীতির সম্পর্ক ছিল না। তিনি বরং ছিলেন রক্ষণশীলদেরই কাছের লোক। হিন্দু পৌরাণিক বহুদেববাদের বিরোধিতা করে ব্রহ্মতত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে রামমোহন ১৮১৫ সালে ‘বেদান্তগ্রন্থ’ ও ‘বেদান্তসার’ লিখেছিলেন। সে লেখার বিরোধিতা করে ‘বেদান্তচন্দ্রিকা’ লিখেছিলেন মৃত্যুঞ্জয়। যা প্রকাশিত হয় ইংরেজি অনুবাদ-সহ। বইটিতে লেখকের নাম ছিল না। কিন্তু স্কুল বুক সোসাইটির একটি রিপোর্টে এই বইয়ের লেখক মৃত্যুঞ্জয় বলেই জানানো হয়েছে।
মৃত্যুঞ্জয় রামমোহনকে তীব্র আক্রমণ করেছিলেন। গোড়াতেই ‘‘তত্ত্বজ্ঞানিমানিরদের স্বকপোলকল্পিত স্বপ্রয়োজন-সিদ্ধি-তাৎপর্য্যক বাক্য-প্রবন্ধ কল্পনার খণ্ডনার্থ ইহা লেখা যাইতেছে এমত কেহ মনে করিও না’’ বলে দিয়ে তাঁর স্বভাবসুলভ শ্লেষাত্মক বক্তব্য, ‘‘হে শিষ্ট সন্তানেরা, তোমরা যদি সাংসারিক সুখাভিলাষী হও তবে বিহিত কর্ম্মানুষ্ঠান পরিত্যাগ করিয়া মোক্ষেচ্ছারূপ মহাবৃক্ষাগ্রারোহণ কদাচিত করিও না।’’ শেষ পর্যন্ত এ প্রসঙ্গে তাঁর যুক্তি, ‘‘যেমন এক চন্দ্র নানাবিধ জলাশয়ে জলসরাবাদিতে অনেকাকারে প্রতিভাসমান হন তেমন এক চেতন ব্রহ্মাদি কীট পর্য্যন্ত নানাবিধ দেহেন্দ্রিয়াদিতে পৃথক্‌ পৃথক্‌ অনেক আকারে বর্ত্তমান আছেন।’’
শাস্ত্রমন্থন করেই সহগমনের বিরোধিতা করে রক্ষণশীলদের মুখ বন্ধ করে দেওয়ার মধ্যে বিদ্যাসাগরের ছায়া আছে। কিন্তু, শাস্ত্রানুরাগী মৃত্যুঞ্জয়ের নারী সম্পর্কে ধারণা মোটেই আধুনিক নয়। ১৮০৮ সালে অনূদিত ‘হিতোপদেশ’-এ মৃত্যুঞ্জয় লিখছেন, ‘‘অপর মাদক দ্রব্যের পান ও দুর্জন সংসর্গ ও পতিবিরহ ও যথেষ্ট গমন ও স্বপ্ন ও অন্যগৃহে বাস এই ছয় স্ত্রীদিগের দূষণ। আর নির্জ্জন স্থানে থাকে না এবং অবকাশ কাল থাকে না এবং প্রার্থনাকর্ত্তা মনুষ্য থাকে না হে নারদ সে নিমিত্তে স্ত্রীরদিগের সতীত্ব হয়। অপর স্ত্রীরদের অপ্রিয় কেউ নাই প্রিয়ও কেউ নাই যেমন গরু সকল বনেতে নূতন ২ ঘাস প্রার্থনা করে সেই রূপ নূতন ২ পুরুষকে প্রার্থনা করে অপর ভাই কিম্বা পুত্রকে সুন্দর দেখিয়া স্ত্রীরদিগের .......... ক্লেদযুক্ত হয় হে নারদ এ বাক্য সত্য ২।’’
তিনি, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার, আসলে এক পা রেখেছিলেন সুতানুটিতে। আর একটি পা ফোর্ট উইলিয়মে।

Comments (0)

Leave a reply