কহবতীর নাচ - উতপলকুমার বসু
১.
একাধিকবার এই সৈকতে এসে
বলেছি আমার মতো পুরুষকে তো কিছু
কলঙ্কের ভাগ তুমি দিতে পারো। হয়নি,
শোননি কেউ, শুধু বালিয়াড়ি ধসে
পড়েছে সাগরজলে।
স্তব্ধতা থেকে কোলাহলে
আবার যাত্রা শুরু, পাপ থেকে
পাপের স্খালনে। ঝাউবনে উড্ডীন
পতাকাবিদ্রোহ থেকে রঞ্জনরশ্মির অনলে--
চলেছি সকলে।
এই মদ কিভাবে করব পান--
বলে দাও। দাঁড়িয়ে জলের ধারে?
ছিঁড়ে-আনা এই ফুলগুলি
ঘুমন্ত খ্রিস্টগাছে ফুটেছিল--
কীভাবে ভাসবে তারা মাতৃসমা জলে?
২.
যে তমসা নদীর তীরে আমি আজ বসে আছি তার বালুকণাগুলি আমাকে
জানাতে চাইছে আমি জল থেকে কতটা পৃথক--তার ঢেউগুলি আমাকে
বোঝাতে চাইছে আমি গাছ নই, আর গাছের আড়ালে ঐ ধাঙরবস্তির এক
মদ্যপানরত যুবক আমাকে বলতে চাইছে আমি পক্ষীরাজ, মেঘ থেকে নামলাম,
এইমাত্র, সাক্ষাৎ তারই চোখের সামনে--
হবেও-বা। তাহলে বর্ষার আঁধার সকালে আমি ডানা গুঁজে বসে থাকি। রোদ
উঠলে উড়ে যাব।
৩.
দু-হাত শূন্যে তুলে কেঁদে উঠি, 'প্রভু, ওটা আমাকেই দিতে হবে।'
লোকে প্রচণ্ড আমোদ পায়--বলে, 'তোর আমড়াগাছির যেন শেষ নাই,
আবার দেখা তো দিকি ঐ খেলা', আমি আবারো দেখাই
মাঝে-মধ্যে অতিরিক্ত কিছু হাঁপ জুড়ে দিই, যথা, ' এসেছিনু ভবে'
অথবা 'নিঠুর', এ-সব গৌণ গান তুমিও গাইতে পারো;
লোক হাসে--এর চেয়ে বড় কথা আর আছে নাকি?
দিনের প্রখর রৌদ্রে বনতলে পড়ে রয় অজস্র জোনাকি
মূক ও মৃত্যুমুখী, শরীরের নীল আলো জ্বলে কারো কারো।
৪.
বালক-বালিকা ও পেশীবহুল গ্রাম্য-সভার কাছে আমি দাবি করি- কই হে,
আমাকে একটা ঝুমঝুমি দাও, যে-কটা দিন আছি টেনে বাজাই। অসংখ্য আত্মজীবনী,
দিনলিপি ও সম্পত্তি-হস্তান্তরের দলিল আমি এবারের গ্রীষ্মের ছুটিতে পড়ে
ফেলেছি--জানালা দিয়ে দেখেছি দূরে উড়ে চলা ঐ শুকনো পাতাগুলো ক্রমে বহু
তক্ষকে রূপান্তরিত হল এবং তারপর ঘুরতে ঘুরতে নামহীন চিত্রময় সাপ হয়ে তার
মাটির অধিকতর ভিতরে মিশে গেল-- অথচ তোমরা তো বলেই খালাস যে রূপের
কখনো রূপান্তর হয় না, ধুলোর শরীর নাকি ধুলোতেই ফিরে যায়, পর্বতপ্রমাণ ছায়া
এখানে-ওখানে পড়ে আছে দেখেও এ-কথা কেউ কি নিশ্চিতভাবে বলতে পারে যে
আমাদের দেশে একদা লোকজনের বসবাস ছিল? ওরা ধ্বসস্তুপ থেকে বেরিয়ে-
আসা আমাদের আত্মীয়-পরিজন, যখন এবারের পঞ্চায়েত উপনির্বাচনের কথা ভাবছে,
তখন আমিই হঠাৎ বলে উঠি--যাই চাটুজ্জেদের বাড়ি নতুন বৌটির সঙ্গে দু-কথা কয়ে
আসিগে।
৫.
হাড় ও কঙ্কাল শুধু, আমি তাকে পাঁজাকোলে করে
চেয়ারে বসিয়ে দিই, অম্নিই বসে থাকে,
ঝঞ্চাট করে না, কখনো হেলান দিয়ে দেয়ালে
সাজিয়ে রাখি--বেশ থাকে কোনাভাঙা, চাটগাঁ-র ভাষায়
এটা-সেটা বলে, তবে কোনো দাবিদাওয়া নেই,
যেসব পুরুষদের বৌ-রা চাকরি করে তাদের মুখের দিকে
অপলক চেয়ে থাকে--ভয় পায় বিসর্জনের
ঢাক শুনে, ভাবে বুঝি তাকেও নদীর জলে ফেলে দেওয়া হবে।
৬.
শ্রীচশ্পা কখনো পথে কখনো-বা মেঘের সদরে ফুটে থাকে। আজ
বৃদ্ধ সমুদ্র আর লোহাজাল খাঁড়ির দেয়ালে আক্রোশে আছড়ে পড়ছে।
অতিশয় ফাটল দেখেছি। উপকূলরক্ষীদের ঘরগুলি
ছন্নছাড়া, ভগ্নদশা--শ্রাবণের কটাল-জোয়ারে থই থই।
ফিরে আসব শীতের ছুটিতে। তখন এ-তটরেখা সরে যাবে বহুদূর।
পথের দু-পাশে শ্বেত, বৃষ্টিহীন মেঘে আর পরিত্যাক্ত ঘরে ঘরে
শুরু হবে ফুলের উৎসব। অনেকেই তখন আসবে।
৭.
এবার যদি আমি ফিরে আসি তবে আমি নীল রঙ হয়ে ফিরে আসব।
বৃষ্টিশেষে মেঘের ফাঁক দিয়ে বাংলার আকাশে যে নীল রঙটুকু দেখা যায়
আমি তারই মতো হাল্কা কিছু বলার চেষ্টা করব--
যে-কথায় কোনও জড়তা নেই--যাকে না বুঝলে
কারো ভাতকাপড়ে টান পড়বে না--কেউ বলতে পারবে না
তোমাকে বুঝলুম না হে, তোমাকে একেবারেই বোঝা গেল না।
তখন তুমিও সাদা রঙ হয়ে ফিরে এসো।
হাতে-বোনা খদ্দরের হিংসাহীনতা হয়ে তুমি যেন আমাদের
সবার চৈতন্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকো--যে সাদা রঙ দাবি করে
'আমাকে বুলেটবিদ্ধ করো, আমাকে রক্তছাপে ভরিয়ে তোলো,
আমাকে স্বাধীনতা দাও।'
৮.
জড়তা নামছে, ঋষি, এসো ভাইবোনেদের ডাকি।
পড়ার টেবিলটুকু ওখানেই পাতা থাক যাতে সহজে নাগাল পাই--
যাতে দ্রুত লিখে যেতে পারি কেমন লাগল আজ এ-বেলার
আভ্যন্তরীণ শান্ত রক্তপাত--শ্রবণ কিভাবে নিল
দূর তরুলতাহীন শূন্য থেকে ভেসে আসা কবিদের বৃন্দগান--
সুতোবাঁধা উপহার পেয়ে তার কেমন ভাবনা হল, মানে এই
পক্ষাঘাতগ্রস্থ জড় দেহটির। কে পাঠাল এতসব ছেঁড়া জার্সি, হাফপ্যান্ট,
ফটোর শুকনো মালা, আর স্কুলের প্রথম অক্ষরটানা খাতাটিও
এতদিন কাদের সংগ্রহে ছিল? কীভাবে বা ফিরে এল?
ভুলগুলি তেমনই রয়েছে। কেউ কেন শুধরে রাখেনি?
Comments (0)
Leave a reply